বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভুত

বাংলার_বিভিন্ন_ধরনের_ভুত

অমিতাভ_ব্যানার্জী

ভুত চতুর্দশী তো সবাই জানে কিন্তু ভুত সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি?
বাংলায় তো আজকাল আধুনিকতার ঠ্যালায় সাধারণত আমরা শুধু ভুতুরে ভোটার ছাড়া আর কোনো ভুতের ই খোঁজ পাইনা।
ভুত – আক্ষরিক অর্থে প্রাচীন, কিন্তু লৌকিক মতে “প্রেত” বা “প্রেতাত্মা”, বা মৃত্যু পরবর্তী অতৃপ্ত আত্মা। এ অনেকটাই বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার।
তবে, বিধিবদ্ধ সতর্কিকরন হিসেবে বলতে পারি এই তথ্য পুরোটাই কুসংস্কার জনিত কিন্তু মজার ব্যাপার এইটাই একমাত্র তত্ত্ব যা সারা পৃথিবীতে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানে। তাই ভুত প্রেতের ই একমাত্র প্ৰকৃত বিশ্বায়ন হয়েছে। এর কারন নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। তবে আমার মনে হয় মানুষের মৃত্যভয়ই এর কল্পনা সৃষ্টি করেছে।
যাইহোক, গম্ভীর ব্যাপারস্যাপার বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি।
বাংলা সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে; তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো।

পিশাচ - পিশাচ একধরনের পুরাণের দানব বা শয়তান যা মানুষের মৃতদেহ ভক্ষণ করে, সাধারণত অ-মৃত হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এ কিন্তু দেহধারী। পিশাচতত্ত্ব নিয়ে প্রায় সব ধর্মের নিজস্ব মতামত রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিদ্যমান প্রাচীনতম সাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে পিশাচরা সম্ভবত এক হাজার এবং এক রাত্রি বাঁচে।

পেত্নী - পেত্নী হলো নারী ভূত যারা বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত প্রেতিনী শব্দ থেকে এসেছে যা পুরুষবাচক শব্দ প্রেত থেকে এসেছে। এসব ভূত সাধারনত যে কোন আকৃতি ধারন করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এসব ভূত সাধারনত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারনত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমনের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো।

শাকচুন্নি - শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ''শঙ্খচুরনী'' থেকে এসেছে। এটা হলো বিবাহিত মহিলাদের ভূত যারা লালসাদা কাপড়, সিঁদুর এবং হাতে শঙ্খ বা শাঁখা পড়ে। শাকচুন্নিরা সাধারনত  বিবাহিত মহিলাদের ভেতর ভর করে বা আক্রমণ করে যাতে করে তারা নিজেরা সেই মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে পারে। লোকগাঁথা অনুসারে তারা গাছে বসবাস করে। হিন্দি মতে একেই “চুরেইল” বলে, অর্থাৎ চুরি পরিহিত প্রেতিনী।

চোরাচুন্নি - চোরাচুন্নি অত্যন্ত দুষ্ট ভূত। এরা মানুষের অনিষ্ট করে থাকে। সাধারনত কোন চোর মৃত্যুবরণ করলে চোরাচুন্নিতে পরিনত হয়। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িতে গঙ্গাজলের ব্যবস্থা করা হয়।

পেঁচাপেঁচি - এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূত ধারনাটি পেঁচা থেকে এসেছে এর স্ত্রী বাচক হলো পেঁচি। এরা জোড়া ধরে শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এরা সাধারনত জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও এরা শিকারের দেহ ছিড়ে ছিড়ে খায়।

মেছোভূত - এ ধরনের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো শব্দটি বাংলা মাছ থেকে এসেছে। মেছো ভূত সাধারনত গ্রামের কোন পুকুর পাড়ে বা লেকের ধারে যেখানে বেশি মাছ পাওয়া যায় সেখানে বসবাস করে। মাঝে মাঝে তারা রান্নাঘর বা জেলেদের নৌকা থেকেও মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে কেউ মাছ কিনে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ফিরলে এটি তার পিছু নেয় এবং নির্জন বাঁশঝাঁড়ে বা লেকের ধারে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে মাছ ছিনিয়ে নেয়।

দেও - এধরনের ভূত নদীতে বা লেকে বসবাস করে। এরা লোকজনকে জলে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়।

নিশি - ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের গলায় নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ফেরে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিনত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনী অনুসারে নিশিরা কোন মানুষকে দুবারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই কারো উচিত কেউ তিনবার ডাকলে বের হওয়া, তাতে নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।

মামদো ভূত - হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমান আত্মা।

গেছোভূত - গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে।

ব্রহ্মদৈত্য - এধরনের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারনত কারো ক্ষতি করে না। এ ধরনের ভূতরা হলো ব্রাহ্মণের ভূত সাধারনত এরা ধূতি ও পৈতা পরিহিত অবস্থায় বিচরণ করে। এদেরকে পবিত্র ভূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা অত্যন্ত দয়ালু ও মানুষকে অনেক উপকার করে থাকে। বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে এদের চরিত্র চিত্রায়িত হয়।

আলেয়া - রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া দেখা যায়। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেয়া এর উৎপত্তি। এর ফলে জেলেরা ভুল বুঝে ভয় পেয়ে মৃত্যুবরণ করে।

বেঘোভূত - এরা হলো সেইসব মানুষের আত্মা যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সাধারনত সুন্দরবন এলাকায় এধরনের ভূতের কথা বেশি প্রচলিত কারণ বাঘের বাস হলো সুন্দরবন। এসব ভুতেরা জঙ্গলে মধু আহরনে আগত গ্রামবাসীদের ভয় দেখায় এবং বাঘের সন্নিকটে নিয়ে যেতে চেষ্ঠা করে। মাঝে মাঝে এরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য বাঘের স্বরে কেঁদে ওঠে।

স্কন্ধকাটা/কন্ধকাটা/ কবন্ধ - এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। সচরাচর এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে যেমন, রেল দূর্ঘটনা বা অন্য কোন দূর্ঘটনা। এ শ্রেণীর ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায় এবং অন্য মানুষকে আক্রমণ করে তাদের দাসে পরিণত করে ও তার মাথা খোঁজার কাজে নিয়োগ করে।

কানাভুলো - এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে। ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছবার পর তার শিকারকে মেরে ফেলে। এক্ষেত্রে শিকার তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এধরনের ভূতদের রাতে গ্রামের মাঠের ধারে পথের মধ্যে দেখা যায়। শিকার সবসময় একাকী থাকে বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ডাইনী -ডাইনী মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। বাংলা লোকসাহিত্যে সাধারনত বৃদ্ধা মহিলা যারা কালো জাদু বা (ডাকিনীবিদ্যা) তে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনীরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের রক্ত খেয়ে ১০০ বছর বেঁচে থাকে।

ঝেঁয়ো পেত্নী - সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যাবেলায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরুতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এ জাতীয় পেত্নীরা।

ডাকিনী - ডাইনি বুড়িদের অনুগতশ্রেণির ভূত। পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে এরা। থাকে পুকুর বা দিঘীর ধারে কোনো তাল বা নারকেল গাছে। রাতদুপুরে মেয়েদের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।

তথ্য সূত্র:- গুগল, উইকিপেডিয়া ও বাংলা অভিধান।

(#অমিতাভ)

Comments

Popular posts from this blog

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কিকরে?

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কারা?