বিশ্বনাথ স্যার স্মরণে

বিশ্বনাথ স্যার স্মরণে:-

বহুদিন পর্যন্ত বিশ্বনাথ স্যারকে অনেক ছাত্রছাত্রীই ব্রহ্মানন্দ স্যার বলে সম্বোধন করতো। স্কুলে প্রথম আসার পর এই রকম একটা জোড়া নামের শিক্ষক কে নিয়ে বেশ কৌতুহল জেগেছিল। একজনের দুটো নাম কেন? সহপাঠীদের মধ্যে অনেককে জিজ্ঞেস করে বিশেষ কোনো সমাধান পেলাম না। একজন তো এই বলেই ক্ষ্যান্ত দিলো যে- নিশ্চয়ই ব্রহ্মানন্দ নামটা স্যারের ডাক নাম, কারন স্কুলের টিচার দের নামের রেজিস্টারে তার নাম বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্য ই লেখা থাকে।আমার কিন্তু সন্দেহ বা কৌতূহল যাই হোক, গেল না। স্যারকে জিজ্ঞেস করার মত সাহসও নেই। অন্য স্যারদের কেও যে জিজ্ঞেস করবো তাতেও ছাত্রসুলভ কুন্ঠাবোধ ছিল। আমি নিজের দিক থেকেই সিধান্ত নিলাম, অন্য অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের মত আমি ব্রহ্মানন্দ স্যার বলবো না। তার টিচার রেজিস্টারে লেখা বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য্য অর্থাৎ বিশ্বনাথ স্যারই বলবো। লক্ষ্য করতাম অনেক ছাত্রবন্ধুই নামটার অনভ্যাসের জন্য তাতে একটু অবাকই হতো, তবে কেউ কিছু বলতো না বিশেষ, কারন সবাই জানত আমি ভুল নই। লক্ষ্য করলাম আমার সাথে স্কুলে যোগ দেওয়া নতুন ছাত্রেরা কিন্তু সবাই তাকে বিশ্বনাথ স্যারই বলতো। বরং পুরোনোদের মধ্যেই ব্রহ্মানন্দ নামটা বেশি চালু ছিল।

   ক্লাস সেভেনে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল থেকে চোখের সমস্যার কারনে এই বাংলা মিডিয়াম এ ভি বি স্কুলে এসে আমার বাংলা ভাষার প্রতি ভিতীকে ভালোবাসায় পরিণত করার কৃতিত্বের প্রায় পুরোটাই আমি বিশ্বনাথ স্যারকে দি। ওঁর বাংলা ব্যাকরণ কে সহজ করে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করানোর উপায়কে আমি প্রণাম করি। তার আগে বাংলা ব্যাকরণ আমার কাছে প্রায় একটা গোলকধাঁধাই ছিল। তার সাথে উনি আমাকে প্রায় হাতে ধরে শব্দের মার প্যাঁচ বোঝাতেন, যা পরের দিকে আমার কাছে একটা খেলায় পরিণত হয়। তবে মজার ব্যাপার, স্যার কিন্তু আমাকে তার বিখ্যাত গাঁট্টার মাধুর্য্য থেকে বঞ্চিতই রেখেছিলেন। কেন কে জানে? শুনেছি একমাত্র বন্ধুবর সত্রাজিতকেই(@Satrajit Roy) আমার মত উনি গাঁট্টা বঞ্চিত রেখেছিলেন। হয়তো ভেবে ছিলেন, এই দুটোর মাথা বেশি ঝাঁকালে হয়তো যাও কিছু বুদ্ধি আছে সেটাও নড়ে যাবে!

  উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় অনেকেই প্রাইভেটে বাংলা পড়েনা। আমি কিন্তু স্যারের সান্নিধ্য পাবার জন্যই হোক বা বাংলার প্রতি আকর্ষণেই হোক, অমরাবতী টিচার্স কলোনিতে স্যারের নির্মিয়মান বাড়িতে গিয়ে বাংলা পড়তাম প্রতি রবিবার সকালে।

 সেই সময় স্যারের সাথে সম্পর্কটা আরো অনেক সহজ হয়ে যায়। তখনই একদিন স্যারের মন বুঝে তার দুটো নামের রহস্য জানতে চাই। তিনি প্রথমে বেশ, "বলবোনা বলবোনা" জাতীয় হাব ভাব করলেন আর মিটি মিটি হাসতে থাকলেন। তবু আমি সাহস পেয়ে জোর করায়, তিনি জানালেন যে, যে সময় তিনি স্কুলে যোগ দ্যান, সেই সময়েই তার ঠিক আগে আর একজন ব্রহ্মানন্দ নামের স্যার স্কুলে যোগ দিতে আসেন, কিন্তু তাঁর বাড়ির থেকে দূরত্বের কারনে, সরকারের কাছে আবেদন করায় বিশ্বনাথ স্যারকে তার জায়গায় বদলি করে আনা হয়, এবং ঐ ব্রহ্মানন্দ বাবুকে বিশ্বনাথ স্যারের জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মানে অদলা বদলি আরকি। কিন্তু ওই যে একদিনের জন্য ব্রহ্মানন্দ স্যার স্কুলে এসেছিলেন, তার আগে থেকেই কোনো কারণে তার নাম বেশ প্রচার পেয়ে যায়, কিন্তু তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও দু একজন সিনিয়ার শিক্ষক ছাড়া কেউই দেখেনি, কারণ তিনি নাকি কিছুক্ষন থেকেই বেরিয়ে গেছিলেন। অথচ এর মধ্যেই স্কুলে তার আসার খবর ছড়িয়ে পড়ায় সবাই ওই নামের শিক্ষকের জন্যই তৈরি ছিল। তার দু একদিনের মধ্যেই বিশ্বনাথ স্যার যোগ দেওয়ায়। ওই ব্রহ্মানন্দ নামটা তার ঘাড়েই চেপে যায়। প্রথম প্রথম তিনি নাকি সবার ভুল শোধরাবার চেষ্টা করে ছিলেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই তিনি হাল ছেড়ে দেন।

  অবশ্য, শেষে আমাকে হাসতে হাসতে বলেন, তার বাবা তাকে শিবের নাম দিয়েছিল, আর চাকরি তাকে ব্রহ্মার নাম দিয়েছে, এরপর অবসরে তিনি "নারায়ণ নাম" নেবেন। শুনে তখনই ওই বয়সে তার কথার অর্থের অতটা গুরুত্ব বুঝিনি বটে, কিন্তু আজ তিনি চলে যাবার পর যেন ওই কথাটাই মনের মধ্যে বার বার ফিরে ফিরে আসছে। 

 প্রার্থনা করি তার আত্মা যেন তার ইচ্ছে মত ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ত্রিশক্তিতে ই মিলিত হয়ে চিরশান্তি লাভ করেন।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভুত

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কিকরে?

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কারা?