বাংলার ইতিহাস একটু অন্য চোখে
'দেশভক্ত' সিরাজ-উদ-দৌলা
বনাম
'বেইমান ' মীরজাফর।
মীর জাফর আলী খান বাহাদুর ওরফে মীরজাফরকে ইতিহাসবিদরা অনেকেই বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেন।
এই প্রসঙ্গে একটু ফিরে দেখা l
"বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব কে ছিলেন?"
নিশ্চয়ই সবাই একবাক্যে বলবেন,
কেন? নবাব আলীবর্দি'র নাতি সিরাজউদ্দৌলা।।
কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, নবাব আবার "স্বাধীন" হতে পারেন কি ভাবে ?
এখন যদি বলা হয় "স্বাধীন গভর্নর"! কথাটা কেমন শোনায় ? গভর্নর (ইং ) যেমন স্বাধীন হতে পারেন না, তেমনি নবাব ও না l
উভয়ের মানেই তো এক, প্রাদেশিক শাসনকর্তা । আর যিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা হন, তিনি তো অবশ্যই দিল্লী'র বাদশা'র পদানত।
আরও একটা কথা উল্লেখ্য। সিরাজ'কে তো প্রকৃত পক্ষে নবাব বলাই উচিৎই নয়। কারন তার কাছে দিল্লী'র বাদশাহেরও কোন নবাবী ফর্মানই ছিল না। তবে । সিরাজের দাদু ( মাতামহ ) আলীবর্দি'র কাছে সে ফর্মান থাকায়, তাকে নবাব ( স্বাধীন নয় ) বলা যেতেই পারে ।
আলিবর্দি'র মৃত্যুর পর তার বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের ছেলে তথা বিহারের পূর্নিয়ার শাসনকর্তা সৌকতজঙ্গ যখন দিল্লী'র দিকে ফর্মান আনতে ছোটেন, পথেই সিরাজের চর তাকে গুপ্তহত্যা করে।
এই ভাবে সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করে সিরাজ তা দখল করলেও দিল্লীর বাদশাহের কাছে তার কোন আদৌ বৈধতা ছিল না।
ওদিকে বাদশাহের সিপাহশালার ছিলেন মিরজাফর। অর্থাৎ মিরজাফর ছিলেন আজকের প্রেসিডেন্টের অধীন, কলকাতা ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল অফিসার ইন কমান্ড (জি ও সি)।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই যেখানে সিরাজের কাছে নবাবী করারই কোন বৈধ সিলমোহর ছিল না, তাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি মিরজাফর বরং দিল্লীর বাদশাহের (ফারুখশায়ার) দুর্বলতার সুযোগে চেয়েছিলেন ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে কি ভাবে বাংলার শাহেনশা হওয়া যায়।
ধরুন, আজ যদি বাংলার কোন গভর্নর যুদ্ধ লড়তে চান, আর তার জন্য তিনি সেনাবাহিনী'র ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে সর্বোত ভাবে সাহায্য চান, তবে কি ফল হতে পারে? প্রেসিডেন্ট বা দিল্লী'কে এড়িয়ে সেই ব্রিগেডিয়ার সাহেব কি তার অনুরোধ রাখতে এগিয়ে আসবেন?
হা... ইতিহাস...! সিরাজ নাকি বাংলা বিহার উড়িষ্যা'র শেষ স্বাধীন নবাব! - আর যত দোষ, সব মিরজাফরের!
আসলে কি জানেন?
সিরাজ কে বাংলার ' শেষ স্বাধীন নবাব ' এই সোনার পাথরবাটি মার্কা উপাধিটা দিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার সিরাজদৌলা নাটকে।
উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম কে একসাথে ইংরেজ- বিরোধী করে তোলা। তিনি ঘটনাতে এত রং চরিয়েছিলেন এবং তা মঞ্চস্থ হওয়ায় এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, তাই সত্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এই বোধহয় বাংলার সবচেয়ে পুরোনো তথাকথিত রচিত সত্য / 'পোস্ট ট্রুথ' এর বড় উদাহরণ ।
ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
সাধারণত সিরাজ কে শেষ স্বাধীন নবাব আর মির কাসেমকে অনেকেই শেষ নবাব বলেন । কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই ভুল তথ্যে ভরা। তথ্য ও যুক্তি গুলো ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দেখুন ---
নবাব উপাধিটির ইংরেজি ভাবানুবাদ গভর্নর বা ভাইসরয় তাই স্বাধীন নবাব কথাটা যেন সোনার পাথরবাটি। তা সে যতই দাদাগিরি করুক না কেন। সত্যিই স্বাধীন হলে তাকে সুলতান বলা হতো।
শেষ নবাব ব্যাপারটা এইরকম।
সিরাজ আসল নবাব ছিলেননা, কারন দিল্লির বাদশার শেষ ফরমানে তার দাদু আলিবর্দী কে নবাব করা হয়েছিল, মির জাফর তারই অধীনস্ত বাদশাহি সিপাহসালার। সিরাজের নামে কোনো ফরমান আসেনি যদিও সে চেষ্টা করেছিল, তাই আইনত আলিবর্দী ই দিল্লির মুঘল বাদশাহের অধীনে বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ নবাব।
মিরকাসেম দিল্লির অধীনস্ত নবাব ছিলোনা, তার আগে ইংরেজরা মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে, বাংলা, বিহার, ওড়িশার সম্পুর্ন দখল নিয়ে নেয় এবং মীর জাফর কে নবাব করে, তারপর তাকে সরিয়ে তার জামাই মির কাসেমকে বসায় কিন্তু মিরকাসেম অশান্তি করায় (বাক্সারের যুদ্ধ, যা মোটেই দেশের জন্য ছিলোনা ছিল আরো বেশি ক্ষমতা লাভের জন্য) তাকে সরিয়ে আবার মির জাফর কে বসানো হয়। তাই মির কাসেম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত দ্বিতীয় নবাব।
শেষ নবাব ব্যাপারটা আবার একটু আপেক্ষিকও।
আলীবর্দী ছিলেন মুঘল বাদশার অধীনস্ত বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ নবাব। তারপর ইংরেজ দের অধীনে ১৭৫৭ সাল থেকে মীরজাফর কে দিয়ে শুরু করে, পরবর্তী কালে বিহারকে আলাদা করে দিয়ে ১৮৮০ সালে নবাব সৈয়দ মনসুর আলী খান কে বাংলা ও উড়িষ্যার নবাব উপাধি থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়। তাই সৈয়দ মনসুর আলী খান ই হলেন ইংরেজ অধীনস্ত বাংলার শেষ নবাব। (আমি নবাব কে পদ না বলে শুধু উপাধি বলেছি কারন তখন আর তার কোনো নবাবীর ক্ষমতাই ছিলোনা, শুধু উপাধিটাই ছিল)। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট স্বাধীন ভারত সরকারের হুকুমে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর উপাধিটা ও তুলে দেওয়া হয়, তখন মুর্শীদাবাদের শেষ নবাব বাহাদুর ছিলেন ওয়ারিশ আলী মির্জা (তার উত্তরাধিকারী আইনত ঠিক হয় ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে) তাই ঠিকমত বললে ওয়ারিশ আলী মির্জা ই মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব।
প্রসঙ্গত, ১৭৫৬ তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবাব নিয়োগ করার অধিকার ছিলোনা কিন্তু তখন মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে জোর যার মুলুক তার। তাই যে সুযোগ নিয়ে সিরাজ নবাব(তথাকথিত স্বাধীন) হয়েছিলো, সেই সুযোগ নিয়েই ইংরেজরাও দিল্লির বাদশার সমান মালিক হয়ে বসেছিল।
তখন ব্রিটিশ রা ভারতে স্রেফ একটা আঞ্চলিক শক্তি ছিল। ওদের সাথে অন্য রাজা বা নবাবদের বিশেষ তফাৎ ছিল না। ওরাও তখন জাহাঙ্গীর ও পরবর্তী মুঘল সম্রাটের কাছে জায়গীর ও ব্যবসার অনুমতি নিয়েই কাজ শুরু করে।তাই পলাশীর যুদ্ধ বা তৎপরবর্তী বক্সারের যুদ্ধ আসলে স্রেফ আঞ্চলিক জায়গীর বা জমিদারি বা নিদেনপক্ষে এলাকা দখলের লড়াই ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নয়। একে সাহিত্যিকরাই মহান বানিয়েছেন।
তবুও,
একটা বড় তফাৎ হয়তো আছে, বাকিরা ব্যক্তিগত ভাবে এই লাইসেন্স পেয়েছিল। হ্যাঁ ব্যাপারটা লাইসেন্সেরই রকমফের ছিল। কিন্তু ইংরেজরা সমষ্টিগতভাবে একটি কোম্পানির (ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) মাধ্যমে এই জায়গীর পেয়েছিল, যে কোম্পানিটি ব্রিটিশ সরকারের লাইসেন্স প্রাপ্ত অংশীদারী/ 'শেয়ারহোল্ডিং ' কোম্পানি, যার মধ্যে অন্য ইউরোপীয় দেশের ও কিছু নাগরিক ছিল।
(এখানে একটা এনরন , লয়েডস ব্যাঙ্ক , হর্ষদ মেহতা মার্কা গল্পও আছে। এবং অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশেরও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের কোম্পানি ছিল।) সুতরাং এখানে ব্যাপারটা লাইসেন্সের ওপর লাইসেন্স। লর্ড ক্লাইভ ছিলেন এই কোম্পানিটির (বর্তমানের প্রেক্ষিতে) ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যবসার (ইস্ট ইন্ডিজ ইউনিট ) একজন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক / সি ই ও ( চিফ একজিকিউটিভ অফিসার ,তারও কিছু অংশভাগ /শেয়ার ছিল) l মানে তিনি লভ্যাংশ-চুক্তি ( কমিশন-এগ্রিমেন্ট এ ) -তে থাকা স্রেফ এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তাই সেই হিসেবে সে যদি নিজে রাজত্ব দখল করার চেষ্টা করতো তবে ইংল্যান্ডের ফৌজদারি আইনে দোষী সাব্যস্ত হতো এবং ইংল্যান্ডের সরকার তার বিরুদ্ধে ইংরেজ ফৌজ পাঠাত। যা প্রতিহত করার মতো শক্তি লর্ড ক্লাইভের থাকার কথা নয় কারন কোম্পানির সৈন্যরা ছিল বেতনভুক ও ভাড়াটে সৈন্য, তারা ব্রিটিশ সরকারের বেতনভুক ছিল না ।
প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ র বিদ্রোহের পর এই ব্যাপারই ঘটেছিল, ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পুর্ন ব্যবসা ও সম্পত্তি নিজের অধিকারে নিয়ে তাকে সরকারি সম্পত্তি বানিয়েছিল (আজকের প্রাইভেট থেকে পাবলিক এর রকমফের), এইটাই আক্ষরিক অর্থে উপনিবেশীকরণ বা কলোনাইজেশন। তার আগের গুলো হলো কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা বা কোম্পানি ঔন্ড বিজনেস, তাই তখনকার দিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুদাম গুলোকে ফ্যাক্টরি নামে অভিহিত করা হত।
এই কোম্পানির কর্মী লর্ড ক্লাইভ প্রথমে ছিলেন গভর্নর পদে(তার আগেও ২/১ জন ছিল মাদ্রাজে নিযুক্ত, ইনি স্বাধীন দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা -র প্রতিনিধি হন), পরে ১৭৫৭ র যুদ্ধে জয়ের পুরস্কার হিসেবে তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের গভর্নর জেনারেল -পদে উন্নীত করা হয় কোম্পানির তরফে, এবং এই পদটিকেই ১৮৫৭ সালে বড়লাট বা গভর্নর জেনারেল কাম ভাইসরয় এই পদে পরিবর্তিত করা হয় যার শেষ ব্যক্তি ছিলেন ১৯৪৭ -এ চক্রবর্তি রাজাগোপালাচারী (না মাউন্টব্যাটেন নন)।
লক্ষণীয় যে পদটি শুধু ভাইসরয় ছিল না, কারন সরকারি বেতন ও লভ্যাংশ দুই ই তারা পেতেন সুতরাং তাদের পক্ষেও নিজে রাজত্ব করতে গেলে ফৌজদারী আইনের আওতায় পড়তে হত। কারন তখন ভারতীয় ব্রিটিশ সেনা ব্রিটেন রাজের বেতনভুক হয়ে গিয়েছিল।
এইখানেই ভারতের বাকি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের থেকে ইংরেজদের তফাৎ ... ইংরেজরা ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়েছিল।
সুতরাং,
সিরাজকে দেশভক্ত আর মিরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক এই ভাবে দেগে দেওয়া মোটেই বাস্তব ইতিহাস অনুসারী নয়।আর এটা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস হলেও এর মধ্যে বাঙালিত্ব বা ভারতীয়ত্ব খোঁজা বৃথা কারন এরা কেউই নিজেদের বাঙালি বা ভারতীয় ভাবতেন বা বলতেন বলে কোনো প্রমাণ নেই।
বনাম
'বেইমান ' মীরজাফর।
মীর জাফর আলী খান বাহাদুর ওরফে মীরজাফরকে ইতিহাসবিদরা অনেকেই বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেন।
এই প্রসঙ্গে একটু ফিরে দেখা l
"বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব কে ছিলেন?"
নিশ্চয়ই সবাই একবাক্যে বলবেন,
কেন? নবাব আলীবর্দি'র নাতি সিরাজউদ্দৌলা।।
কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, নবাব আবার "স্বাধীন" হতে পারেন কি ভাবে ?
এখন যদি বলা হয় "স্বাধীন গভর্নর"! কথাটা কেমন শোনায় ? গভর্নর (ইং ) যেমন স্বাধীন হতে পারেন না, তেমনি নবাব ও না l
উভয়ের মানেই তো এক, প্রাদেশিক শাসনকর্তা । আর যিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা হন, তিনি তো অবশ্যই দিল্লী'র বাদশা'র পদানত।
আরও একটা কথা উল্লেখ্য। সিরাজ'কে তো প্রকৃত পক্ষে নবাব বলাই উচিৎই নয়। কারন তার কাছে দিল্লী'র বাদশাহেরও কোন নবাবী ফর্মানই ছিল না। তবে । সিরাজের দাদু ( মাতামহ ) আলীবর্দি'র কাছে সে ফর্মান থাকায়, তাকে নবাব ( স্বাধীন নয় ) বলা যেতেই পারে ।
আলিবর্দি'র মৃত্যুর পর তার বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের ছেলে তথা বিহারের পূর্নিয়ার শাসনকর্তা সৌকতজঙ্গ যখন দিল্লী'র দিকে ফর্মান আনতে ছোটেন, পথেই সিরাজের চর তাকে গুপ্তহত্যা করে।
এই ভাবে সিংহাসনকে নিষ্কণ্টক করে সিরাজ তা দখল করলেও দিল্লীর বাদশাহের কাছে তার কোন আদৌ বৈধতা ছিল না।
ওদিকে বাদশাহের সিপাহশালার ছিলেন মিরজাফর। অর্থাৎ মিরজাফর ছিলেন আজকের প্রেসিডেন্টের অধীন, কলকাতা ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল অফিসার ইন কমান্ড (জি ও সি)।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই যেখানে সিরাজের কাছে নবাবী করারই কোন বৈধ সিলমোহর ছিল না, তাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি মিরজাফর বরং দিল্লীর বাদশাহের (ফারুখশায়ার) দুর্বলতার সুযোগে চেয়েছিলেন ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে কি ভাবে বাংলার শাহেনশা হওয়া যায়।
ধরুন, আজ যদি বাংলার কোন গভর্নর যুদ্ধ লড়তে চান, আর তার জন্য তিনি সেনাবাহিনী'র ইস্টার্ন কমান্ডের কাছে সর্বোত ভাবে সাহায্য চান, তবে কি ফল হতে পারে? প্রেসিডেন্ট বা দিল্লী'কে এড়িয়ে সেই ব্রিগেডিয়ার সাহেব কি তার অনুরোধ রাখতে এগিয়ে আসবেন?
হা... ইতিহাস...! সিরাজ নাকি বাংলা বিহার উড়িষ্যা'র শেষ স্বাধীন নবাব! - আর যত দোষ, সব মিরজাফরের!
আসলে কি জানেন?
সিরাজ কে বাংলার ' শেষ স্বাধীন নবাব ' এই সোনার পাথরবাটি মার্কা উপাধিটা দিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার সিরাজদৌলা নাটকে।
উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম কে একসাথে ইংরেজ- বিরোধী করে তোলা। তিনি ঘটনাতে এত রং চরিয়েছিলেন এবং তা মঞ্চস্থ হওয়ায় এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, তাই সত্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এই বোধহয় বাংলার সবচেয়ে পুরোনো তথাকথিত রচিত সত্য / 'পোস্ট ট্রুথ' এর বড় উদাহরণ ।
ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
সাধারণত সিরাজ কে শেষ স্বাধীন নবাব আর মির কাসেমকে অনেকেই শেষ নবাব বলেন । কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই ভুল তথ্যে ভরা। তথ্য ও যুক্তি গুলো ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দেখুন ---
নবাব উপাধিটির ইংরেজি ভাবানুবাদ গভর্নর বা ভাইসরয় তাই স্বাধীন নবাব কথাটা যেন সোনার পাথরবাটি। তা সে যতই দাদাগিরি করুক না কেন। সত্যিই স্বাধীন হলে তাকে সুলতান বলা হতো।
শেষ নবাব ব্যাপারটা এইরকম।
সিরাজ আসল নবাব ছিলেননা, কারন দিল্লির বাদশার শেষ ফরমানে তার দাদু আলিবর্দী কে নবাব করা হয়েছিল, মির জাফর তারই অধীনস্ত বাদশাহি সিপাহসালার। সিরাজের নামে কোনো ফরমান আসেনি যদিও সে চেষ্টা করেছিল, তাই আইনত আলিবর্দী ই দিল্লির মুঘল বাদশাহের অধীনে বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ নবাব।
মিরকাসেম দিল্লির অধীনস্ত নবাব ছিলোনা, তার আগে ইংরেজরা মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে, বাংলা, বিহার, ওড়িশার সম্পুর্ন দখল নিয়ে নেয় এবং মীর জাফর কে নবাব করে, তারপর তাকে সরিয়ে তার জামাই মির কাসেমকে বসায় কিন্তু মিরকাসেম অশান্তি করায় (বাক্সারের যুদ্ধ, যা মোটেই দেশের জন্য ছিলোনা ছিল আরো বেশি ক্ষমতা লাভের জন্য) তাকে সরিয়ে আবার মির জাফর কে বসানো হয়। তাই মির কাসেম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত দ্বিতীয় নবাব।
শেষ নবাব ব্যাপারটা আবার একটু আপেক্ষিকও।
আলীবর্দী ছিলেন মুঘল বাদশার অধীনস্ত বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ নবাব। তারপর ইংরেজ দের অধীনে ১৭৫৭ সাল থেকে মীরজাফর কে দিয়ে শুরু করে, পরবর্তী কালে বিহারকে আলাদা করে দিয়ে ১৮৮০ সালে নবাব সৈয়দ মনসুর আলী খান কে বাংলা ও উড়িষ্যার নবাব উপাধি থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়। তাই সৈয়দ মনসুর আলী খান ই হলেন ইংরেজ অধীনস্ত বাংলার শেষ নবাব। (আমি নবাব কে পদ না বলে শুধু উপাধি বলেছি কারন তখন আর তার কোনো নবাবীর ক্ষমতাই ছিলোনা, শুধু উপাধিটাই ছিল)। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট স্বাধীন ভারত সরকারের হুকুমে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর উপাধিটা ও তুলে দেওয়া হয়, তখন মুর্শীদাবাদের শেষ নবাব বাহাদুর ছিলেন ওয়ারিশ আলী মির্জা (তার উত্তরাধিকারী আইনত ঠিক হয় ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে) তাই ঠিকমত বললে ওয়ারিশ আলী মির্জা ই মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব।
প্রসঙ্গত, ১৭৫৬ তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবাব নিয়োগ করার অধিকার ছিলোনা কিন্তু তখন মুঘলদের দুর্বলতার সুযোগে জোর যার মুলুক তার। তাই যে সুযোগ নিয়ে সিরাজ নবাব(তথাকথিত স্বাধীন) হয়েছিলো, সেই সুযোগ নিয়েই ইংরেজরাও দিল্লির বাদশার সমান মালিক হয়ে বসেছিল।
তখন ব্রিটিশ রা ভারতে স্রেফ একটা আঞ্চলিক শক্তি ছিল। ওদের সাথে অন্য রাজা বা নবাবদের বিশেষ তফাৎ ছিল না। ওরাও তখন জাহাঙ্গীর ও পরবর্তী মুঘল সম্রাটের কাছে জায়গীর ও ব্যবসার অনুমতি নিয়েই কাজ শুরু করে।তাই পলাশীর যুদ্ধ বা তৎপরবর্তী বক্সারের যুদ্ধ আসলে স্রেফ আঞ্চলিক জায়গীর বা জমিদারি বা নিদেনপক্ষে এলাকা দখলের লড়াই ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নয়। একে সাহিত্যিকরাই মহান বানিয়েছেন।
তবুও,
একটা বড় তফাৎ হয়তো আছে, বাকিরা ব্যক্তিগত ভাবে এই লাইসেন্স পেয়েছিল। হ্যাঁ ব্যাপারটা লাইসেন্সেরই রকমফের ছিল। কিন্তু ইংরেজরা সমষ্টিগতভাবে একটি কোম্পানির (ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) মাধ্যমে এই জায়গীর পেয়েছিল, যে কোম্পানিটি ব্রিটিশ সরকারের লাইসেন্স প্রাপ্ত অংশীদারী/ 'শেয়ারহোল্ডিং ' কোম্পানি, যার মধ্যে অন্য ইউরোপীয় দেশের ও কিছু নাগরিক ছিল।
(এখানে একটা এনরন , লয়েডস ব্যাঙ্ক , হর্ষদ মেহতা মার্কা গল্পও আছে। এবং অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশেরও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের কোম্পানি ছিল।) সুতরাং এখানে ব্যাপারটা লাইসেন্সের ওপর লাইসেন্স। লর্ড ক্লাইভ ছিলেন এই কোম্পানিটির (বর্তমানের প্রেক্ষিতে) ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যবসার (ইস্ট ইন্ডিজ ইউনিট ) একজন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক / সি ই ও ( চিফ একজিকিউটিভ অফিসার ,তারও কিছু অংশভাগ /শেয়ার ছিল) l মানে তিনি লভ্যাংশ-চুক্তি ( কমিশন-এগ্রিমেন্ট এ ) -তে থাকা স্রেফ এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তাই সেই হিসেবে সে যদি নিজে রাজত্ব দখল করার চেষ্টা করতো তবে ইংল্যান্ডের ফৌজদারি আইনে দোষী সাব্যস্ত হতো এবং ইংল্যান্ডের সরকার তার বিরুদ্ধে ইংরেজ ফৌজ পাঠাত। যা প্রতিহত করার মতো শক্তি লর্ড ক্লাইভের থাকার কথা নয় কারন কোম্পানির সৈন্যরা ছিল বেতনভুক ও ভাড়াটে সৈন্য, তারা ব্রিটিশ সরকারের বেতনভুক ছিল না ।
প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ র বিদ্রোহের পর এই ব্যাপারই ঘটেছিল, ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পুর্ন ব্যবসা ও সম্পত্তি নিজের অধিকারে নিয়ে তাকে সরকারি সম্পত্তি বানিয়েছিল (আজকের প্রাইভেট থেকে পাবলিক এর রকমফের), এইটাই আক্ষরিক অর্থে উপনিবেশীকরণ বা কলোনাইজেশন। তার আগের গুলো হলো কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা বা কোম্পানি ঔন্ড বিজনেস, তাই তখনকার দিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুদাম গুলোকে ফ্যাক্টরি নামে অভিহিত করা হত।
এই কোম্পানির কর্মী লর্ড ক্লাইভ প্রথমে ছিলেন গভর্নর পদে(তার আগেও ২/১ জন ছিল মাদ্রাজে নিযুক্ত, ইনি স্বাধীন দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা -র প্রতিনিধি হন), পরে ১৭৫৭ র যুদ্ধে জয়ের পুরস্কার হিসেবে তাকে ভারতীয় উপমহাদেশের গভর্নর জেনারেল -পদে উন্নীত করা হয় কোম্পানির তরফে, এবং এই পদটিকেই ১৮৫৭ সালে বড়লাট বা গভর্নর জেনারেল কাম ভাইসরয় এই পদে পরিবর্তিত করা হয় যার শেষ ব্যক্তি ছিলেন ১৯৪৭ -এ চক্রবর্তি রাজাগোপালাচারী (না মাউন্টব্যাটেন নন)।
লক্ষণীয় যে পদটি শুধু ভাইসরয় ছিল না, কারন সরকারি বেতন ও লভ্যাংশ দুই ই তারা পেতেন সুতরাং তাদের পক্ষেও নিজে রাজত্ব করতে গেলে ফৌজদারী আইনের আওতায় পড়তে হত। কারন তখন ভারতীয় ব্রিটিশ সেনা ব্রিটেন রাজের বেতনভুক হয়ে গিয়েছিল।
এইখানেই ভারতের বাকি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের থেকে ইংরেজদের তফাৎ ... ইংরেজরা ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়েছিল।
সুতরাং,
সিরাজকে দেশভক্ত আর মিরজাফরকে বিশ্বাসঘাতক এই ভাবে দেগে দেওয়া মোটেই বাস্তব ইতিহাস অনুসারী নয়।আর এটা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস হলেও এর মধ্যে বাঙালিত্ব বা ভারতীয়ত্ব খোঁজা বৃথা কারন এরা কেউই নিজেদের বাঙালি বা ভারতীয় ভাবতেন বা বলতেন বলে কোনো প্রমাণ নেই।
Comments
Post a Comment