রিহার্সাল
রিহার্সাল
অমিতাভ_ব্যানার্জী
রিহারসাল...হ্যাঁ রিহারসাল...মানে বাংলায় যাকে বলে মহড়া। নাট্য জগতের এক চরম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। নাট্য জগতের সব কিছুকে নিয়ে পরীক্ষা, পরিবর্তন ও উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু মহড়া! মহড়ার জায়গা বা গুরুত্বের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মহড়া অর্থে প্র্যাক্টিস। "practice makes perfect" এই আপ্তবাক্য সর্ব কালে সর্ব ক্ষেত্রে সত্য। যত প্রাক্টিস তত নিখুঁত, এ অনস্বীকার্য।
কিন্তু এ হেন রিহার্সাল ও যে নাটকের বিপদের কারন হতে পারে তা কে জানতো?
আমার বাবা ছিলেন গ্রুপ থিয়েটার এর একজন যথেষ্ট নামি পরিচালক, যদিও মফস্বলের তবু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যোগ দিয়ে কলকাতা ছাড়ার আগে তাঁর অনেক পরবর্তীকালের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত পরিচালকের সাথেই বন্ধুত্ব ছিল। এবং পত্র পত্রিকায় লেখালেখি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া বিভিন্ন পুরস্কার ও কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে প্রচুর "কল শো" করার দরুন তার এই সমস্ত বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ভালোই ছিল।
যাই হোক, যখনের কথা বলছি তখন বাবা আর একাঙ্ক নাটক তো করেনই না বরং বহু জায়গায় নাট্য প্রতিযোগিতায় বিচারের ও আলোচনার জন্য যেতে হয়।
তখন আমি কলেজে পড়ি। জন্ম ইস্তক নাটক দেখে দেখে, একধরনের নেশা জন্মে গেছে, কিন্তু অন্য শহরে পড়াশুনার কারণে তার সুযোগ বেশ কমে গেছে। তা, একবার ছুটিতে বাড়ি এসেছি, বাবা একটু দূরের এক জায়গায় জাজ হিসেবে যাবেন, আমিও পিছু নিলাম। সাধারনতঃ জাজ হলে বাবা নিতেন না সাথে, কারন উদ্যোক্তারা অকারণে আমাকেও গুরুত্ব দিত, যা বাবার মোটেও পছন্দ ছিল না। মানে, তুমি গুরুত্ব পেলে নিজের জন্য পাও আমার নামে কেন?
তা সেবার বাবার অমন ই এক নামকরা নাট্যকার বন্ধুর ওই প্রতিযোগিতায় আসার কথা এবং ওনার তৈরি করা একটি নতুন গ্রুপের ওই প্রতিযোগিতার শেষে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ করার কথা এবং তা পুরোপুরি উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে, প্রদর্শনী মূলক ও নতুনদের উৎসাহ দেবার উদ্দেশ্যে। তাই ওঁর নাটক দেখাবার উদ্দেশ্যে বাবা আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন।
সকাল ১০টা/সাড়ে ১০টা থেকেই প্রতিযোগিতা শুরু। খান ৬/৭টা গ্রুপ আছে, আরো নাকি ছিল কিন্তু আগেই ঝাড়াই বাছাই হয়ে গেছে। সময় একটা বড় বিষয়। কারন মোটামুটি ৮টা থেকে ওই নামকরা নাট্যকারের নাটক এবং তা প্রায় দু/আড়াই ঘন্টার পূর্ণাঙ্গ। রাতে লোকজনকে তো ফিরতে হবে? যদিও আমাদের চিন্তা নেই কারন উদ্যোক্তাদের পৌঁছে দেবার কথা। দুপুরের খাওয়া আর বিকেলের জলখাবার ওখানেই হবে তাই তার আগে চিন্তার কোনো কারণ নেই, এ ক্ষেত্রে অবশ্য বাবার আপত্তি ছিল, কিন্তু উদ্যোক্তারা জোর করায় তা টেকেনি।
আমি তো ওঁর নাটক দেখার জন্যই গেছি। বাকিগুলো দেখছি, ওই দেখতে হবে বলে দেখা, তাও ওই বাবার থেকে দূরে পিছনে বসে। এই রকম নাটক চলতে চলতেই হাতে হাতে খাবার এসে গেল, সে সময় কৌতূহল প্রকাশ করায় জানলাম তাঁরা এখনো আসেননি এবং বিকেলে আসবেন। যাই হোক অবশেষে প্রতিযোগিতা শেষ হলো। পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা পরদিন হবে। আসলে ওই নামি পরিচালকের ডেট পেতেই পুরস্কার বিতরনের সময় পিছিয়ে পরদিন করা হয়েছে।
যাই হোক, অবশেষে বেলা ৮টা নাগাদ প্রতিযোগিতা শেষ হলো এবং আধঘন্টার বিরতি। জানলাম বেলা ৬টা নাগাদ তাঁরা এসে গেছেন এবং মহড়ায় লেগে পড়েছেন। বাবা এই সময় উঠে গিয়ে ওঁর সাথে একবার দেখা করতে গেলেন। যাবার সময় আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক দেখলাম নিজেই অভিনয় করবেন, পুরো ধড়াচূড়া পরে তৈরি, শুধু ফাইনাল মেকআপ চলছে তাঁর। ওদিকে পুরোদমে মহারাও চলছে। একটি আমার থেকে একটু বড় ছেলে দেখলাম খুব মন দিয়ে মহড়া দেখছে, কিন্তু তার মেকআপ হয়ে গেছিল বলে বোধহয় লাফালাফি করছিল না, নাকি অন্য কোনো কারণ হবে হয়তো!
যথারীতি, নাটক শুরু হলো। বাবা এবার আমাকে তার সাথে সামনের সারিতে নিয়ে এলেন, ভালো করে দেখাবার জন্য। ভিড়ও বেশ বেড়ে গেছে, হল প্রায় ভর্তি, অনেকে শুধু এই নাটকটাই দেখতে এসেছেন। নাটক চলতে থাকলো। বেশ একাধারে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী, বাস্তব ধর্মী, সামাজিক ও বৈপ্লবিক ভাবধারার নাটক। ওই পরিচালক এক লম্বা দাঁড়ি গোঁফ ওয়ালা বৃদ্ধ আদর্শবাদী এক গ্রামের শিক্ষক চরিত্রে অভিনয় করছেন আর ওই ছেলেটি তার এক প্রিয় ছাত্র। ভালোই লাগছিলো, বেশ টান টান গল্প। মোটামুটি বিরতি অবধি গল্প বেশ তর তর করে এগুলো। ঠিক বিরতির আগে একটি রেষারেষির ঘটনায় শত্রুপক্ষের হাতে ছেলেটির চরিত্রটি খুন হয়ে গেল। ব্যাস, বিরতি।
বিরতির পর শুরু হলো আদর্শবাদী আন্দোলন ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধের টানাপোড়েন। শেষ পর্যন্ত আদর্শেরই জয় হলো। এই উত্তেজনার মধ্যে শেষ দৃশ্য এসে গেল। শেষ দৃশ্যে ওই বৃদ্ধ শিক্ষকরুপী পরিচালক একটি উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছেন, ওই বেদিতে সেই ছেলেটির দেহ চাদর দিয়ে ঢাকা অবস্থায় শায়িত, আর তিনি সাধারণ গ্রামবাসীকে নির্দেশ দিচ্ছেন, এবং তারা প্রত্যেকে হাতে একটি করে জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে এক উইং দিয়ে ঢুকে পুরো স্টেজটি ও ওঁকে ক'বার পরিক্রমা করতে করতে ধীরে ধীরে অন্য উইং দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আলো খুব আস্তে আস্তে কমে এসে ওই দেহটি ও শিক্ষকের ওপর ফোকাস হচ্ছে এবং বাকি অঞ্চল ডিমড আলো ছড়িয়ে থাকছে। প্রায় দশ/বারো জনের দল। এইরকম দুঃখের উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে একটা চাপা হাসির রোল উঠলো, আমি বেশ মন দিয়ে দেখছিলাম কারন একে তো ভালো লাগছিলো তার ওপর বাবা সাধারনতঃ বাড়ি ফিরে নাটকটা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও আলোচনা করতো, উল্টোপাল্টা বললে পরেরবারের নাটক দর্শন বাতিল হবার সম্ভাবনা ছিল তাই মনোযোগ দিয়ে দেখতেই হতো। আমি ঐ হাসির শব্দে চমকে উঠে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। পাশে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রথমে যেন বেশ একটু রেগে যাবার মত ভাব দেখলাম মুখে, তারপরেই তিনিও মিচকি মিচকি হাসতে লাগলেন যেন। স্টেজের দিকে ফিরলাম, এবার হাসির কারণটা বোধগম্য হলো। দেখি ওই বিরতির আগে খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটি মোমবাতি হাতে সবার পেছনে মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে, একবার মনে হলো মাথাটা তুললো কিন্তু আবার মাথা নিচু করে এগিয়ে চললো এবং ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল, পর্দাও নামতে থাকলো আর হাসির হুল্লোর ও বেড়ে গিয়ে, হল যেন ফেটে পড়ল।
নাটক.......শেএএএএষ!!!!
বাবা দেখলাম তখন স্বাভাবিক। হাসির রোলের মধ্যেই ভিড় ভেঙে গিয়ে লোকজন উঠে বাইরে যাবার তোড়জোড় করছে। বাবা আমার হাত ধরে টান দিলো। আমরা উল্টো রাস্তায় গ্রিনরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। ব্যাপারটা নিয়ে খুব কৌতূহল হচ্ছে। এতো বড় ভুল হয় কি করে তা জানতেই হবে।
ভেতরে ঢুকে দেখি লঙ্কাকান্ড চলছে। পরিচালক ভদ্রলোক ছেলেটিকে এই মারে কি সেই মারে অবস্থা, অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছেন, আর কলারটা ধরে রয়েছেন, বাবা পেছন থেকে তার বন্ধুকে টেনে না ধরলে বোধহয় ছেলেটি কয়েক ঘা থাপ্পড় খেয়ে যেত। বাকি কলাকুশলী ও দলের লোকেদের তো প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা, সব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অত বড় মানুষের ক্রোধ সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। নেহাৎ বাবা বন্ধু স্থানীয় বলে তিনি কিছুটা সংযত হলেন। আর ছেলেটি তো হাউ হাউ করে কাঁদছে। তাকে অবশ্য অপেক্ষাকৃত সিনিয়ার কয়েকজন চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর সব কিছুটা ঠান্ডা হলো। রাতও অনেক হয়েছে। ওঁরা যদিও সকালে যাবেন। আমাদের তো ফিরতে হবে। বাবা একটু গম্ভীরভাবে কেলেঙ্কারির কারণটা জানতে চাইলেন।
জানা গেল সব দোষ রিহারসালের। ছেলেটি খুবই বাধ্য ও নিয়মানুবর্তী। কোনো মহড়াই সে বাদ দিতনা, এবং শুরু থেকে শেষ অবধি থাকতো। চেয়ার টেবিল পাতা থেকে গুটানো অবধি সে দায়িত্ব নিত। যথারীতি প্রতি মহড়াতেই কেউ না কেউ অনুপস্থিত থাকতো, অথবা কোনো কারণে আগে বেরিয়ে যেত। এবং যেহেতু ওই মিছিলের দৃশ্যটি অপেক্ষকৃত সহজ এবং অনেকেই তাই থাকতো না, মাথার সংখ্যা বাড়াবার জন্য ওই ছেলেটিকে প্রতিবারই ডেকে নেওয়া হতো এবং সে শেষেই থাকত। নাটকের দিন দ্বিতীয় পর্বে নকল মৃতদেহ চাদর ঢাকা থাকায়, তারও যেহেতু কোনো কাজ ছিলোনা তাই সেও অভ্যাস বসতঃ সবার পেছনে মোমবাতি হাতে এগিয়ে গেছিল। আর পরিচালক নিজে অভিনয়রত থাকায় এবং শেষ দৃশ্যে সবাই প্রায় উল্টোদিকের উইং এ চলে যাওয়ায় তাকে বাধা দেবারও প্রায় কেউ ছিলোনা, শুধু মোমবাতি হাতে ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেবার দায়িত্বে থাকা একটি জুনিয়ার ছেলে এপারের উইংএ ছিল। একবার সে মাথা তোলায় পরিচালক তার দিকে ভস্ম করার মত কটমট করে চাওয়ায় সে কিছু বুঝতে না পেরে আবার মাথা নিচু করে ফেলে।
আসলে, গোলমালটা আরেক জায়গায় ও হয়েছে। পরিচালক মশাই এতই বড় মানুষ আর এই নতুন দলটা এতই অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞদের দিয়ে তৈরি যে কাউকেই তিনি আলাদা করে সহ পরিচালকের দায়িত্ব দেন নি। তাছাড়া তার মধ্যেও অপেক্ষাকৃত জুনিয়ারদেরকে তিনি গল্পটি ভালো করে বোঝানইনি। যার ফল এই মারাত্মক অঘটন।
অনেক রাতে উদ্যোক্তাদের গাড়িতে ফিরতে ফিরতে বাবা বললো, "দেখলি তো যত বড় অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষই হোক না কোনো শিল্পসৃষ্টির সময় যদি কোনো কিছুকে একটুও গুরুত্ব কম দেয় তবে তার কি সাংঘাতিক পরিণতি হতে পারে। আমার মতে ওই বাচ্চা ছেলেটার থেকেও বড় ভুল করেছেন ওই পরিচালক, অনভিজ্ঞ বলে গুরুত্ব কম দিয়ে।"
আমি কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, শেষ অবধি ওই না বুঝে অতিরিক্ত রিহারসাল-ই কাল হলো।
(#অমিতাভ)
Comments
Post a Comment