দাগ

#দাগ

#অমিতাভ_ব্যানার্জী

ছেলেটা মিশন থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক দিলো। জীবন বিজ্ঞান বা ডাক্তারি নিয়ে পড়ার খুব ইচ্ছে, কিন্তু হবে না বোধহয়। বাবা দাদা চান ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করে ফেলে ওর আরো সমস্যা হয়েছে। ডাক্তারিও পেয়েছে কিন্তু বাবার সমর্থন নেই, কারন ওতে নাকি দাঁড়াতে অনেক বেশি সময় লাগে। বাবা ছিলেন একসময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতা, বহু বছর তার দল সরকারে ছিল, কন্ট্রাক্টারী ও করতেন। ছেলেদের ভবিষ্যতের জন্য যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থা তার করা আছে। ওদিকে দাদা, বাবার বিপরীতে বর্তমান সরকারের হয়ে কাজ করে বেশ উন্নতি করেছে। তার ইচ্ছে ভাই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ে তাদের পারিবারিক ব্যবসার উন্নতি করুক।

  তার ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর তাকে দেখা শোনা করা বাবার পক্ষ্যে বেশ কঠিন হওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে এক মিশনের আবাসিক ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। আর এখন তার জীবনবিজ্ঞান নিয়ে পড়াই হোক আর অন্য কোনো ব্যাপারই হোক বাবা দাদার অপছন্দের কিছু হলেই ওই স্কুলের শিক্ষার ওপর দোষ পড়ে।

  পরীক্ষা শেষ, কি পড়বে তাও এখনো ঠিক হয়নি। ছেলেটির মিশন থেকে ফিরে আর ঘরে থাকতে ভালো লাগেনা। বাসে করে এক বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে বেরিয়েছে। কিন্তু কি মুশকিল বাসে এমনিতে তো সব সিট ভর্তি, শুধু পেছনের দিকে একটা টু সিটার খালি, সেটারও জানলার ধারে একটি বারো তেরো বছরের মেয়ে বসে আছে। মিশনে পড়ার জন্যই হোক বা নারীবর্জিত পরিবারে মানুষ হওয়ার জন্যই হোক ছেলেটি একদম মেয়েদের সঙ্গ ঠিকভাবে নিতে পারেনা, তার ওপর মেয়েটির আধুনিক পোশাকও তার অস্বস্তির বড় কারণ। কিন্তু কি আর করা যাবে, বন্ধুর বাড়ি অনেকটাই দূর, অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন। বাধ্য হয়েই ছেলেটি মেয়েটির পাশে বসলো। বসেই বুঝলো মেয়েটি কাঁদছে, ওর আরো বাজে লাগলো, একে তো আধুনিকা পোশাকে মেয়ে তার ভালো লাগেনা, তার ওপর যদি পাশে বসে এমন কাঁদে তবে তো আরো সমস্যা। যাক ভাগ্য ভালো মাত্র একটা স্টপেজ বাদ দিয়েই মেয়েটি নামার জন্য উঠে গেল।
 
  ফাঁকা সিটে জানলার দিকে সরে বসতে গিয়েই ছেলেটি সিটের ওপর কিছু লক্ষ্য করলো। ওটা কি বোঝার পর, তার সারা জীবনেও সে এমন চমকায়নি। মনটা তার এতই বিক্ষিপ্ত ও বিরক্ত হয়ে গেল যে সে সাথে সাথে উঠেই বাস থেকে নেমে পড়লো।
 
  নেমেই লক্ষ্য করলো মেয়েটি তার আগে এইখানেই নেমেছে এবং ওর সামনেই ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছে। মেয়েটির খোলা পায়ের দিকে নজর পড়তেই, ওর কি মনে হলো কিছুটা দূরত্ব রেখে ও মেয়েটির পেছনে যেতে শুরু করলো। নিজেও বুঝতে পারছিল, এ তার স্বভাব ও শিক্ষা বিরুদ্ধ। ওদিকে রাস্তার লোক কিছু সন্দেহ করলে, ও কি বোঝাবে? জায়গাটা বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়, বাবা দাদা জানতে পারলে আরো বিপদ। কিন্তু কিসের টানে যেন ও মেয়েটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললো।

  কিছু দূর গিয়ে মেয়েটি একটি চওড়া গলিতে ঢুকলো, গলিটা বেশ ফাঁকা, ও একটু দ্রুত মেয়েটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলো। মেয়েটি মনে হলো যেন ওকে লক্ষ্য করেছে, কারন তার হাঁটার জোর বেড়ে গেলো। ছেলেটি কিসের প্রভাবে চলেছে? কেন চলেছে? নিজেই ভাবতে পারছেনা। মেয়েটির সাথে দূরত্ব বাড়তে শুরু করতেই সে মেয়েটিকে ডেকে ফেললো, "এই যে শুনছো"। মেয়েটি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে প্রায় দৌড়তে শুরু করলো। ভাগ্যিস গলিটা ফাঁকা, নয়তো কপালে দুঃখ ছিল। কিন্তু ছেলেটা তো আর পেছোতে পারছে না, ওর যে কিসের এই টান ও নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না। আর এখন যেন ওর মধ্যে একটা জেদ চেপে গেছে। নাঃ, আর নয়, ও এবার দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার রাস্তা আগলে দাঁড়ালো।

 মেয়েটি ভীষন ভয় পেয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। ছেলেটির মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, "ভয় পেও না, আমি বাজে ছেলে নই। একটা কথা ছিল।" মেয়েটি ভাবলো হয়তো ছেলেটি তাই বলবে যা সে এত কাল জেনে এসেছে। হয়তো প্রেম নিবেদন করবে, বা নিদেনপক্ষে বন্ধুত্ব করতে চাইবে। এদিকে তার আজ শরীর আর দিচ্ছেনা, ভীষন মাকে পেতে ইচ্ছে করছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে, এখনো প্রায় পনেরো মিনিটের হাঁটা। কিন্তু ছেলেটি বললো,"আমি বুঝতে পারছি তুমি একটা সমস্যায় পড়েছ। আমি তোমাকে সাহায্য করতেই এসেছি।" মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, "কি সাহায্য? তুমি আমার সম্বন্ধে কি জানো?" ছেলেটি বললো, "যা তোমার সমস্যা তা স্বাভাবিক, এখন এই রাস্তায় তুমি দাঁড়িয়ে থাকলে তো তার সমাধান হবেনা, তুমি আমার সাথে এসো, সময় নষ্ট করোনা।" মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো, "কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?" ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না, শুধু ইঙ্গিতে আবার বড় বাস রাস্তার দিকে তাকে চলতে প্রায় আদেশ করলো। মেয়েটিও ভয় পেয়েই হোক বা অন্য কোনো কারণে, অনিচ্ছা সত্বেও পেছন ফিরে চলতে শুরু করলো। ছেলেটি ওর ঠিক পেছন পেছনে কিন্তু খুব কাছাকাছি হাঁটতে থাকলো।

 বড় রাস্তায় পৌঁছে, ছেলেটি মেয়েটিকে প্রচুর দোকানের মাঝে একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে গেল, দোকানদারের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে কি বললো, দোকানদার তার দিকে কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো, তারপর একটা খবরের কাগজে মোরা প্যাকেট দিলো। ছেলেটি দাম দিতে গেলে দোকানদার নিলো না। ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে এসে কাছেই একটা মেয়েদের জামাকাপড়ের দোকানে ঢুকলো।

  ভেতরে দু একজন মহিলা কর্মচারী ছিল, তাদের মধ্যে যে প্রধান তাকে ছেলেটি ওই কাগজের প্যাকেটটা দিয়ে আবারও কিছু বললো। মহিলা তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে টেনে নিয়ে দোকানের ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। কিছু ক্ষণ পর মেয়েটিকে নিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে এলো। তারপর একজনকে বললো একটা রিক্সা ডাকতে, মেয়েটির জন্য। মেয়েটি কিন্তু তখনও কাঁদছে। দোকানের মহিলাটি ছেলেটিকে বললো, "বাবাঃ, তোমার বয়সী একটা ছেলে, ওর এই সমস্যা কি করে বুঝলে? ওকে সাহায্য করার সাহসই বা পেলে কি করে?"

  ছেলেটি বললো, "জানিনা, কি করে করলাম, তবে জীবন বিজ্ঞান আমার প্রিয় সাবজেক্ট, আমি জেনেছি এই বয়সের মেয়েদের জীবনের এই সমস্যা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তা অনেক সময়ই এমন হঠাৎ অসময়ে আসে যে, তা সামলানো খুবই কঠিন। তাছাড়া, কদিন আগেই "পাডম্যান" দেখেছি, তাঁর সম্বন্ধেও পড়েছি। বাসের সিট থেকে ও উঠে যাবার পর, সিটে দাগ দেখি, আর ওর কান্নার ব্যাপারটা খেয়াল করে আমি সমস্যাটা আন্দাজ করি, বাস থেকে নেমে ওকে দেখে আমি নিশ্চিত হই। কিন্তু তারপর যা করেছি তার কি কারন, আমি নিজেও জানিনা, সব কেমন পরপর হয়ে গেল।" মহিলাটি বললো, "তুমি জানোনা, তুমি ছেলে হয়ে কত বড় কাজ করেছ। আমি তোমার মত ছেলেকে জেনে গর্ব বোধ করছি, এমন ছেলে আমি কোনদিনও দেখিনি। এরপর থেকে ছেলেদের সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেল।"

 বাইরে এসে ছেলেটি মেয়েটিকে রিকশায় বসালো, মেয়েটি তখনো কাঁদছে। ছেলেটি মেয়েটির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললো, "কেঁদোনা, আর কোনো ভয় নেই। যাও, এবার বাড়ি যাও, যা হলো মাকে ছাড়া কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, আর আমার কথাটা মাকেও বলো না। এবার থেকে সাবধানে চলা ফেরা কোরো।" এই বলে ছেলেটি কাছের বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। ওকে এরপর ডাক্তারি পড়তেই হবে, তার জন্য যদি বাবা দাদার বিরুদ্ধে যেতে হয় তাও।

(#অমিতাভ)

Comments

Popular posts from this blog

বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভুত

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কিকরে?

মহাভারত একটু অন্য চোখে - কৌরবদের ১০২ জন কারা?